বঙ্গবন্ধুই ছিল প্রকৃত ইসলামের দিশারীঃ

বাংলাদেশকে জানতে হলে প্রথমে স্বাধীনতা সম্পর্কে জানুন, স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। একসময় কিছু বিপদগামী মানুষ চেয়েছিল ইতিহাস মুছে নতুন একটি কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করতে।  যারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে মুসলিম বিদ্ধেষী হিসেবে পরিচিত করার, কারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে ধর্মকেই নির্ভরতার প্রতীক বলে মনে করেন-এই দুর্বলতাটাই কাজে লাগিয়ে চেয়েছিল জনগণকে অপব্যাখ্যার অন্ধকূপে রাখতে। যারা এসব কাজে লিপ্ত ছিলেন এক নজরে তারা দেখে নিন বঙ্গবন্ধুর সঠিক পরিচয়-

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও বাংলাদেশীদের জন্য একজন আলোকবর্তিকা স্বরুপ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্তাকারে শেখ মুজিব বা মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাঙালির স্বাধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব।

প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের ‘জাতির জনক’ বা ‘জাতির পিতাও’ বলা হয়। যদিও জাতীর পিতা বলা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে অনেকের মধ্যেই। তিনি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং শেখ সাহেব হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। তার উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’। তাকে এ নামে ভূষিত করেন বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রবীণ প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ। রাজনীতির পুরোধা এই ব্যক্তিত্বের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী এবং এদেশের পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী।

জন্ম : শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। লুৎফর- সায়েরা দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।

বংশ পরিচয় : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রয়েছে সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তার মাঝে শৈশব থেকেই ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটে। সমৃদ্ধ বংশ পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে।

ইসলাম ধর্মেও বংশ পরিচয়ের মূল্যায়নে শিক্ষণীয় নির্দেশনা দেয়া আছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। মূলত ইসলাম বংশ পরিচয়ের আভিজাত্যকে গৌণ রেখে যোগ্যতা, বিশ্বাস ও ন্যায়নীতি-নিষ্ঠাকে ব্যক্তির মর্যাদার মানদণ্ড নির্ধারণ করে। এ সার্বজনীন ও মানবিক বিধান মেনে বলা যায়-ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় ও বংশীয় ঐতিহ্য অনেক সময় ব্যক্তির রুচিবোধ, স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক বা সম্পূরক ভূমিকা পালন করে।  ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ব্যক্তি ঐতিহ্যগতভাবেই সাধারণত উন্নত মানসিকতা ও সমৃদ্ধ রুচিবোধের পরিচয় বহন করেন।

মুজিবুর রহমান সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারক। তিনি ‘শেখ’ বংশীয় উত্তরাধিকার বহন করেন। ‘শেখ’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে, যার অর্থ শক্তিশালী, বলবান, বিপুল ক্ষমতাধরসম্পন্ন। এটি সম্মানসূচক আরবি অভিধা বা পদবী হিসেবেও পরিচিত। বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাবান শাসকদের উপাধি হিসেবেও শেখ শব্দ-এর ব্যবহার রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও মানুষের নামের পূর্বে এটি ব্যবহৃত হয়।

ল্যাটিন শব্দ ‘সেনেক্স’-এর বাংলা অর্থ ‘বয়োবৃদ্ধ বা সম্মানিত’। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘শেখ’।

বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা : আমাদের এ প্রাচীন বঙ্গীয় জনপদে অসংখ্য ব্যক্তি ইসলামের শাশ্বত বাণী নিয়ে আসেন। তাদের অধিকাংশই আরব ও পারস্য থেকে কালের নানা সন্ধিক্ষণে এ ভূখণ্ডে আগমন করেন। তন্মধ্যে অনেকে ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবী। পরবর্তী কালে আরো আসেন সুফি, দরবেশ, গাউস, কুতুব, অলি ও বুজুর্গ। এমনকি এ উপমহাদেশে ইসলামের প্রচারও হয়েছে ওলী আওলিয়াদের মাধ্যমেই।

তেমনিভাবেই শেখ আউয়াল নামে এমনই একজন দরবেশের আগমন ঘটে এ দেশে। জানা যায় – শেখ আউয়াল ব্যাবিলনীয় সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে বিশ্বখ্যাত অলি হযরত বায়েজিদ বোস্তামির (রাহ.) সফর সঙ্গী হয়ে বঙ্গে আগমন করেন।  ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত ছিল তাদের। এ মহান অলি সমুদ্রপথে জাহাজে করে আসেন। প্রথমে বার ওলি আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে আস্তানা গাড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ আউয়াল দরবেশেরই সপ্তম অধস্তন বংশধর ছিলেন।

শেখ আউয়াল থেকে তার বংশধারা নিম্নরূপ : শেখ আউয়ালের পুত্রের নাম শেখ জহির উদ্দিন। শেখ জহির উদ্দিনের পুত্রের নাম তেকড়ী শেখ। সোনারগাঁও-এ তেকড়ী শেখ অনেককাল বসবাস করেন বলেও তথ্য পাওয়া যায়। এরপর একসময় ব্যবসার উদ্দেশ্যে খুলনায় পাড়ি জমান।

তেকড়ী শেখ এর পুত্রের নাম শেখ বোরহান উদ্দিন। তেকড়ী শেখের উত্তরাধিকারী পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন মধুমতি ও ঘাঘোর নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামটির কথা শোনেন তাঁর এক বন্ধুর কাছে। রূপসা নদী পাড়ি দিয়ে একদিন তিনি সেই বন্ধুর সাথে চলে আসেন টুঙ্গিপাড়ায়। বিয়ে করেন সেখানের বিখ্যাত কাজী পরিবারে, ঘর বাঁধেন চিরকালের জন্য। এভাবেই টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন ঘটে।

বোরহান উদ্দিনের ছিল তিন পুত্র সন্তান। তারা হলেন: শেখ আকরাম, শেখ তাজ মোহাম্মদ ও শেখ কুদরতুল্লাহ। শেখ আকরামের দুই ছেলে ছিলো – শেখ জাকির ও শেখ ওয়াসিম। শেখ ওয়াসিম উদ্দীনের বংশধর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা। শেখ ফজিলাতুন নেছার পিতার নাম মো: জহুরুল হক দুদু মিয়া ও দাদার নাম শেখ মো: আবুল কাশেম।

শেখ জাকিরের তিন ছেলে- শেখ আব্দুল মজিদ, শেখ আব্দুল রাসেল ও শেখ আবদুল হামিদ। শেখ আবদুল মজিদের বংশধর ছিলো আবার বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন।

অপরদিকে শেখ আবদুল হামিদের তিন ছেলে- শেখ লুৎফর রহমান, শেখ শফিউর রহমান ও শেখ হাবিবুর রহমান। এই তিনজনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান। তিনি গোপালগঞ্জ আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন। এবং বঙ্গবন্ধুর মাতার নাম ছিলো সায়েরা খাতুন।

সংক্ষিপ্ত পরিসরে এটাই বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয়ের ক্রমধারা । তাকে খোকা বলে ডাকতেন বাবা লুৎফর ও মা সায়েরা খাতুন। তাদের ধারণকৃত ভিডিও দলিলের বরাত দিয়ে বলা যায়, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন।

জন্মের পর তাঁর নানা শেখ আবদুল মজিদ নাম রাখেন মুজিব অর্থাৎ সঠিক উত্তরদাতা। মা-বাবা তাঁকে ডাকতেন খোকা বলে। সেই খোকা একদিন ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠলেন এবং পরবর্তীতে বাঙালি জাতি তাঁকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

অপরদিকে তার বংশীয় ঊর্ধ্বতনদের খ্যাতনামা আরেক ব্যক্তি হলেন শেখ বোরহান উদ্দিন। তিনি শেখ আউয়ালের ছেলে শেখ জহির উদ্দিনের দৌহিত্র ছিলেন। বোরহান উদ্দিনের বাবা ছিলেন শেখ জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি।

বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প গ্রন্থের বরাত দিয়ে বলা যায়, অলিকুল শিরোমণি বায়েজিদ বোস্তামির (র.) নির্দেশে মেঘনা পাড়ে গমন করেন শেখ আউয়াল। এতদঞ্চলের অধিবাসীদের মাঝে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেন তিনি। পরে সম্ভবত ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে এ দরবেশ চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও এলাকায়। সেই সুবাদে শেখ আউয়ালের সন্তান শেখ জহির উদ্দিনও এ অঞ্চলেই বসবাস করেন। পরে জহির উদ্দিনের ছেলে তেকড়ি শেখ খুলনার দিকে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা।

কালক্রমে উত্থান-পতন ঘটেছে শেখ পরিবারের। নাম-যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ, বিত্ত-বৈভব হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তার সুমহান ঐতিহ্য ও পরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাস কখনই বিস্মৃত হয়নি। বরং সময়ের বিবর্তনে সেই পরিবার সুকীর্তির শীর্ষে উপনীত হয়েছে।

……………… গাজী জাহাঙ্গী আলম ইশান, চেয়ারম্যান, গাজী ফাউন্ডেশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *